শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:১৩ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
কন্ঠের মুগ্ধতায় ও উপস্থাপনার নান্দনিকতায় আলোচিত এক নাম মাসুদ রানা বিশ্ববাঙালি সংসদ বাংলাদেশএর অভিষেক অনুষ্ঠিত বিশ্ববাঙালি সংসদের নবনির্বাচিত কমিটির অভিষেক ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ২৭ সেপ্টেম্বর কসবায় চকচন্দ্রপুর ইসলামিয়া হাফিজিয়া মাদরাসায় হিফজুল কোরআন বিভাগের ৪ ছাত্রের শেষ ছবক প্রদান শিল্প সাহিত্য সংযোগের উদ্যোগে “বিজ্ঞান যুগের সাহিত্যচর্চা” বিষয়ক আলোচনা ও কবিতা পাঠ ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েন্স এওয়ার্ডে ভূষিত বিজ্ঞান কবি হাসনাইন সাজ্জাদী লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন আর নেই কসবার যুবককে স্পেনের ভিসার নামে সৌদির মরুভূমিতে ফেলে রাখার অভিযোগ আজ কবি এস এম শাহনূরের জন্মদিন| বদরুদ্দীন উমর আর নেই
যাব কেল্লা বাবার বাড়ি, মাঝি ভাসাও তরি

যাব কেল্লা বাবার বাড়ি, মাঝি ভাসাও তরি

এস এম শাহনূর।।

“খড়মপুরে গেলে পাবি সোনার মানুষ একজনা,
আশেকের নয়নমণি কেল্লা বাবা মাওলানা”।
আরো কত গানের কলি এখনও কানে বাজে আমার! ছোট বেলায় দেখতাম আমাদের গ্রামের পাশের অদের খাল দিয়ে অসংখ্য মানুষ নেচে গেয়ে, ঢোল- তবলা, বাদ্য বাজিয়ে নৌকায় করে খড়মপুর ওরসে যেত। এখন এ পথে আর দূরপাল্লার পাল তুলা, দাড়টানা নৌকা চলেনা। তবে এখনও ভক্তকুল যায়। আমি শৈশবে আপনজনদের সাথে বেশ কয়েকবার খড়মপুর দরগাহে গিয়েছি। সেই স্মৃতি চোখে ভাসে। কিন্তু ইট পাথরের নগরীতে থাকি বলে এখন আমার আর যাওয়া হয়না।দেখা হয়ে উঠেনা ওরসের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ।

হজরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ (র:) ওরফে কল্লা শহীদ এর মাজার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার খড়মপুরে পুরনো তিতাস নদীর তীরে অবস্থিত। কল্লা শাহ নিয়ে কয়েকটি কাহিনি প্রচলিত আছে—
“খড়মপুরের জেলেরা তিতাস নদীতে মাছ ধরত। একদিন জেলে চৈতন দাস ও তার সঙ্গীরা নদীতে মাছ ধরার সময় হঠাৎ তাদের জালে একটি খণ্ডিত শির আটকা পড়ে যায়। তখন জেলেরা ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং খণ্ডিত শিরটি উঠাতে গেলে আল্লাহর কুদরতে খণ্ডিত শির বলতে থাকে—‘একজন আস্তিকের সাথে একজন নাস্তিকের কখনো মিল হতে পারে না। তোমরা যে পর্যন্ত কলেমা পাঠ করে মুসলমান না হবে ততক্ষণ আমার মস্তক স্পর্শ করবে না।’ খণ্ডিত মস্তকের এ কথা শুনে মস্তকের কাছ থেকে কলেমা পাঠ করে চৈতন দাস ও সঙ্গীরা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যায়। মস্তকের নির্দেশ মোতাবেক ইসলামি মতে খড়মপুর কবরস্থানে মস্তক দাফন করে। ধর্মান্তরিত জেলেদের নাম হয় শাহ বলা, শাহ লো, শাহ জাদা, শাহ গোরা ও শাহ রওশন। তাঁরাই এ দরগাহের আদি খাদেম বা বংশধর। এই দরগাহের খ্যতি ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকেই শাহ পীর সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ ওরফে কেল্লাশহীদের পবিত্র মাজার শরিফ নামে পরিচিতি লাভ করে।
কাহিনীর স্বরূপসন্ধানে—
প্রচলিত আছে, আউলিয়া হজরত শাহ জালাল (র:)-এর সঙ্গে সিলেটে যে ৩ শ ৬০ জন শিষ্য এসেছিলেন হজরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ইয়েমেনের গেজুদারাজ ছিলেন হজরত শাহজালালের ভাগিনা। আরব থেকে যে আউলিয়া ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের একজন গেজুদারাজ। গেছুদারাজ শব্দের অর্থ লম্বা চুলওয়ালা। অত্যাচারের কারণে তৎকালীন শ্রীহট্টের রাজা আচক নারায়ণের বিরুদ্ধে আউলিয়াদের ওই দলটি যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেই যুদ্ধে আউলিয়ারা জয়ী হলেও আচক নারায়ণের সেনাপ্রধান নীলকমলের তরবারির আঘাতে গেছুদারাজের শিরশ্ছেদ হয়। আর সেই শির গিয়ে পড়ে কুশিয়ারা নদীতে। যা ভাসতে ভাসতে তিতাসের মোহনায় এসে জেলেদের জালে ওঠে। এই কাহিনির সঙ্গে কোনো প্রামাণ্য যুক্তি পাওয়া যায় না।

আখাউড়ার খড়মপুরে অবস্থিত হযরত সৈয়দ আহম্মদ গেছুদারাজ (র)-এর দরগাহ যা কল্লা শহীদের দরগাহ নামে সমগ্র দেশে পরিচিত। ২৬০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত দরগাহ শরিফের জায়গা তৎকালীন আগরতলা রাজ্যের মহারাজা দান করেছিলেন।
অনেক খাদেম বলে থাকেন,এই নদীর এক তীর এখানে আর এক তীর ভৈরব। এই পাশে কৈলাশপুর, মাঝে কালিদাস সাগর। সেই সময়ে এই তিন নদীর মোহনায় খুব মাছ ধরা পড়ত। তাই জেলেদের মাছধরার মোক্ষম জায়গা ছিল এই মোহনা। একদিন মোহনায় জেলেদের জালে একটা শরীর বিহীন কল্লা উঠল। প্রথমে জেলেরা ফেলে দিল। আবার জাল ফেলার পর সেই কল্লা আবারও উঠল জালে। এবার কল্লা কথা বলে উঠল, জেলেদের কলমা পড়তে বলল। জেলেরা জানাল, তারা কলেমা জানে না। পরে কাটা শির (কল্লা) জেলেদের কলেমা শিখিয়ে দিল। জেলেরা কলেমা পড়ল এবং কল্লার কথামতো কল্লাটাকে, তিন নদীর মোহনার স্থলভাগে কবর দিল। পরে সেখানে অলৌকিকভাবে মাজার গড়ে উঠেছে।’
প্রচলিত কাহিনির সত্যতা—
হজরত শাহজালাল (র) সঙ্গীদের একজনের নাম সৈয়দ আহম্মদ। যাঁর কারণে অনেকে সৈয়দ আহম্মদ ওরফে গেজুদারাজ বা কল্লা শাহকে শাহজালালের সঙ্গীর শির বলে থাকেন, এটা ঠিক না। শাহজালালের ইতিহাস ৬০০ বছরের। আর কল্লা শাহর (র) ইতিহাস প্রায় ১১ শ বছরের। এর প্রমাণ আছে কমপ্লেক্সের মসজিদে। লোকমুখে জানা যায় ২২০ সালে কল্লা শাহর জন্ম। তিনি ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন। ৩২৩ সালে এই মসজিদটি তৈরি করেন। মসজিদের গায়ে লেখা আছে ৩শ ২৩ ত্রিপুরা। ত্রিপুরায় পুরনো বাংলা সন অনুসরণ করা হয়। কাজেই এই মসজিদের বয়স ১১ শ বছরের মতো। মসজিদ হয়েছে মুসলমানদের জন্য। তার মানে এখানে মুসলমানদের আগমনে মসজিদ হয়েছে। কাজেই কল্লা শাহর ইতিহাস প্রায় ১১ শ বছর বা এর কাছাকাছি।
প্রথম থেকেই কল্লা শাহর উরস ২৬ শে শ্রাবণ থেকে তিন দিনব্যাপী হতো। পরে তা সাত দিনে দাঁড়ায়। আগে এত লোক সমাগম হতো না। এখন লোক সমাগমের সঙ্গে সঙ্গে মাজারের আয়ও বেড়েছে। খড়মপুর শুধু মুসলমনাদের পুণ্যস্থান, তা নয়। সান্দিয়ারা আর কালিদাস গিয়ে যেখানে তিতাসের সঙ্গে মিলেছে সেখানে ফাল্গুনি চাঁদের মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে এই ত্রিবেণীতে পুণ্যস্নান হয়। স্নানে ভারত থেকেও পুণ্যস্নানার্থীরা আসেন।

অনেক ভক্ত মনে করেন এই কল্লা আসলে হোসেনের কল্লা। এভাবে ভক্তের বিশ্বাসে পাখা গজিয়েছে গল্পের। অনেকটা রূপকথার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে কল্লা শহীদের মাজার।চলতি মাসের ১০ আগষ্ট থেকে ৭ দিন ব্যাপী খড়মপুরে চলছে কল্লা শহীদের স্মরণে ওরশ।আজ দিন শেষে মাঝরাতে আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে ২০২৫ সালের ওরশ। হাজার নয়,প্রতিদিন লাখো ভক্ত দরগাহে গিয়ে তাদের মনের আর্তি নিবেদন করছে নানান ভঙ্গিতে।

লেখক: আন্তর্জাতিক কবি, গবেষক ও সম্পাদক

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD